সমস্ত লেখাগুলি

লং লিভ প্রবীর ঘোষ -
চিত্রদীপ সোম
May 19, 2025 | জীবনী | views:3 | likes:0 | share: 0 | comments:0

১৯৯৯ সালে প্রথম দেখা। ক্লাস ইলেভেনের ছাত্র তখন আমি। বাড়িতে লুকিয়ে বর্ধমান থেকে গিয়েছিলাম তাঁর সাথে দেখা করতে, বর্ধমানে যুক্তিবাদী সমিতির শাখা খোলার ব্যাপারে অনুমতি নিতে। 

আর আজ, একটু আগে তাঁর শেষযাত্রার সঙ্গী হলাম। দেহদান করে আসা হলো সাগর দত্ত হাসপাতালে। অবসান হলো একটা যুগের। একটা অধ্যায়ের।

আমার কাছে আজীবন গর্বের বিষয় হয়ে থাকবে এই বিষয়টি যে তাঁর শেষযাত্রার সঙ্গীদের অন্যতম ছিলাম। আক্ষরিক অর্থেই শেষ মুহুর্ত অবধি সাথে ছিলাম তাঁর। মাঝপথে হাত ছেড়ে দিইনি আরও অনেকের মতো।


প্রবীর ঘোষ। শুধু একটা নাম নয়, একটা কিংবদন্তী। উপমহাদেশের বস্তুবাদ চর্চার সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র। সবচেয়ে আলোচিত নাম। আপামর মানুষের কাছে যুক্তিবাদ শব্দটিকে জনপ্রিয় করার, ভাববাদী চিন্তার বিরুদ্ধে পালটা মগজধোলাইয়ের মূল কারিগর৷ আজও শুধু তাঁর নামটাই এক আতঙ্ক বাবাজী মাতাজী জ্যোতিষীদের কাছে৷ জীবিতকালে ফাঁস করেছেন অসংখ্য বাবাজী মাতাজী জ্যোতিষীর ভণ্ডামী৷ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে বারবারই উঠে এসেছেন তিনি। খোদ বিবিসি তাঁর জীবন ও কাজ নিয়ে তথ্যচিত্র বানায় সেই ১৯৯২ সালে৷ এছাড়াও দেশ বিদেশের বহু বিখ্যাত চিন্তাবিদদের আলোচনায় বারবারই উঠে এসেছেন তিনি। ভাববাদ, ঈশ্বরতত্ত্ব, জ্যোতিষ সহ বিভিন্ন বুজরুকির বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন বলিষ্ঠ হাতে। লিখেছেন প্রায় পঞ্চাশটির মতো বই, যার অনেকগুলিই বেস্ট সেলার আজও। নবনীতা দেবসেন, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ’সহ বিভিন্ন লেখক লেখিকা তাঁর আদলে গল্পের নায়ক বানিয়ে গল্প বা উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর লেখা অবলম্বনে হয়েছে জনপ্রিয় সিরিয়ালও।


কেন প্রবীর ঘোষ অনন্য? ভারতে বস্তুবাদ চর্চার ইতিহাসে প্রবীর ঘোষ একমাত্র ব্যক্তি নন। অনেক উজ্জ্বল নক্ষত্র আছেন। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, সুকুমারী ভট্টাচার্য, ভবানীপ্রসাদ সাহু, রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য এরকমই কিছু উদাহরণ। কিন্তু এরা কেউই আমজনতার কাছে নিজের বক্তব্যকে নিয়ে যেতে পারেননি। উক্ত বুদ্ধিজীবীরা জনপ্রিয় ছিলেন শুধুমাত্র শিক্ষিত বিদগ্ধ মহলে। বস্তুবাদ চর্চা ছিল তাঁদের কাছে নিছকই একটা একাডেমিক চর্চার বিষয়। এরা কেউই বুজরুকদের সাথে সম্মুখ সমরে নামেননি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাদের বুজরুকি ফাঁস করেননি। চ্যালেঞ্জ জানাননি। গ্রামেগঞ্জে অনুষ্ঠান করে মানুষের কাছে বস্তুবাদী চেতনার বিস্তার ঘটানোর চেষ্টা করেননি। তাই একটা নির্দিষ্ট গণ্ডীর বাইরে তাঁরা পরিচিতিও লাভ করতে পারেননি। আমজনতার মাঝে তাঁদের চিন্তাধারাকে ছড়াতে পারেননি বিন্দুমাত্র। অন্যদিকে প্রবীর ঘোষ শুধু অ্যাকাডেমিক কচকচানির মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ না রেখে যুক্তিবাদী চিন্তাধারাকে রূপ দিয়েছিলেন আন্দোলনের। পৌঁছে দিয়েছেলেন প্রান্তিক মানুষের কাছে৷ পশ্চিমবঙ্গের প্রতিটা জেলার শহরে, গ্রামে গঞ্জে ঘুরেছেন। হাজার হাজার অনুষ্ঠানে হাতে কলমে ফাঁস করে দেখিয়েছেন বিভিন্ন অলৌকিক কৌশলের বুজরুকি। চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী, জ্যোতিষীদের। ফাঁস করেছেন জ্যোতিষীদের অতীত বা ভবিষ্যৎ বলার রহস্য। চ্যালেঞ্জ জানিয়েছেন ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমানের। এরজন্য একাধিকবার প্রাণঘাতী হামলাও হয়েছে তাঁর উপর। আর এসবই প্রবীর ঘোষকে বানিয়েছে জীবন্ত কিংবদন্তী৷ বানিয়েছে সুপার হিরো। আজ সুকুমারী ভট্টাচার্য বা রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের নাম যত লোক জানে তার একশোগুন বেশী লোক জানে প্রবীর ঘোষের নাম৷ জানে যুক্তিবাদী সমিতির নাম। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘মানুষের নেতা’, এভাবেই তিনি যুক্তিবাদকে পৌঁছে দিয়েছেন সাধারণ মানুষের মাঝে।

প্রবীর ঘোষ যখন যুক্তিবাদী আন্দোলন শুরু করেন তখন এদেশে তথা এ রাজ্যে বিজ্ঞান সংগঠন ছিল হাতে গোনা। টিমটিম করে চলতো সেসব সংগঠন। সাধারণ মানুষ নামও জানতো না তাদের বিশেষ। বিজ্ঞান আন্দোলনের জোয়ার তিনিই প্রথম আনেন এদেশে। একের পর এক জনপ্রিয় বই লিখে, বিভিন্ন অনুষ্ঠান করে, জ্যোতিষী, বাবাজী মাতাজীদের বিভিন্ন বুজরুকি হাতে কলমে ফাঁস করে, রেডিও টিভিতে বিভিন্ন লাইভ অনুষ্ঠানে নামকরা জ্যোতিষীদের নাস্তানাবুদ করে, বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় আর্টিকেল লিখে এমনই এক হাইপ তিনি তৈরি করেন যে প্রায় রাতারাতি রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠতে থাকে বিভিন্ন বিজ্ঞান সংগঠন৷ গড়ে ওঠে কুসংস্কারবিরোধী আন্দোলনের স্বর্ণযুগ। প্রবীর ঘোষ ও যুক্তিবাদী সমিতি আসরে নামার আগে এ রাজ্য তথা এ দেশের আনাচে কানাচে খোঁজ মিলত নানা ‘অলৌকিক’ ক্ষমতার অধিকারী বাবাজী মাতাজীদের। রমরম করে চলত তাদের লোক ঠকানোর ব্যবসা৷ কিন্তু আজ মাথা খুঁড়লেও অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী বাবাজী মাতাজীর দেখা পাওয়া ভার৷ এই কৃতিত্বের সিংহভাগই যে প্রবীরবাবুর অবদান এ কথা অস্বীকার করা যায় না৷ এছাড়াও, যে সময় অধিকাংশ বিজ্ঞান সংগঠন সরাসরি ধর্মের বিরুদ্ধে, ঈশ্বরের বিরুদ্ধে বলতে ভয় পেত, যারা তাদের কাজকর্ম সীমাবদ্ধ রেখেছিল কৃষিতে জৈব সার ব্যবহার, খাবারে ভেজাল ধরার পদ্ধতি ইত্যাদি নিরীহ বিষয়ে, যাতে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের ক্ষোভের মুখে পড়তে না হয়, সেই সময় অসীম সাহসে ভর করে তিনি সরাসরি ঈশ্বরের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। তাঁর লেখা বইয়ে ধর্মকে ‘ক্যানসারের চেয়েও মারাত্মক, পরমানু বোমার চেয়েও বিপজ্জনক’ বলার হিম্মত রেখেছেন। আর এমন একটা সময়ে তিনি এই কাজ করেছেন যখন চারপাশের ১০০% মানুষই ছিল ধর্মবিশ্বাসী, ঈশ্বরবিশ্বাসী। একথা বুঝতে অসুবিধা হয় না, কতটা মেরুদন্ডের জোর, কতটা বুকের পাটা থাকলে তবে ভারতের মতো পিছিয়ে পড়া দেশে দাঁড়িয়ে একথা বলা যায়। 


শুধু কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলনই নয়, তিনি বিশ্লেষণ করেছেন কুসংস্কার টিকে থাকার পিছনে রাষ্ট্রশক্তির ভূমিকাকেও। দেখিয়েছেন কেন রাষ্ট্রশক্তি তোল্লাই দেয় কুসংস্কারকে, তোল্লাই দেয় ভাববাদী চিন্তাধারাকে। দেখিয়েছেন শোষিত মানুষকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন করে রাখতে পারলে, দৈব বিশ্বাসী করে রাখতে পারলে কিভাবে অবাধে শোষন, লুন্ঠন করা যায় তাদের৷ দেখিয়েছেন ভাববাদী চিন্তা কিভাবে প্রতিহত করে গণবিপ্লবের সম্ভাবনা, ঘুম পাড়িয়ে রাখে মানুষের চেতনাকে৷ কোভুর বা জেমস র‍্যান্ডির মতো প্রখ্যাত যুক্তিবাদীরা কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হলেও কুসংস্কার টিকে থাকার পিছনে রাষ্ট্রশক্তির ভূমিকা নিয়ে ছিলেন নীরব। কুসংস্কারের জন্য তাঁরা দায়ী করেছিলেন কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষদেরই। দায়ী করেছিলেন তাদের বিজ্ঞানসম্মত চিন্তাধারার অভাবকে। কুসংস্কারাচ্ছন্ন চিন্তাধারা টিকে থাকার পিছনে রাষ্ট্রের ভূমিকা, পুঁজির ভূমিকা নিয়ে তাঁদের এই নীরব থাকার কারণ হয় তাঁদের অজ্ঞতা, আর নয় রাষ্ট্রশক্তির কোপে পড়ার আশঙ্কা। এদিক থেকেও প্রবীর ঘোষ ছিলেন ব্যতিক্রমী৷ শুধু ভাববাদের বিরুদ্ধে নয়, তিনি মুখ খুলেছিলেন হুজুর-মজুর শ্রেণীকাঠামোর বিরুদ্ধে, সিস্টেমের বিরুদ্ধে। স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন সাম্যবাদের। তিনি দেখিয়েছেন শুধু রাজনৈতিক বিপ্লব শোষণমুক্তি ঘটাতে পারে না, পাশাপাশি চালাতে হয় সাংস্কৃতিক বিপ্লব। যাতে সামন্ততান্ত্রিক, পুঁজিবাদী সমাজের কু-আচার, কু-প্রথা থেকে মানুষ নিজেকে মুক্ত করতে পারে৷ এখানেও তিনি অনন্য। 

বিতর্ক যে তাঁকে নিয়ে হয়নি তা নয়। বস্তুত বিতর্ক ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। কিছু বিতর্ক বা সমালোচনা যেমন ছিল যৌক্তিক, তেমনই ছিল কুৎসার, অপপ্রচারের বন্যা৷ কুৎসাকারীরা তাঁকে টেনে নামাবার, মিথ্যা অভিযোগে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টার কসুর কোনওদিনই করেনি। এরমধ্যে জ্যোতিষী, বাবাজী মাতাজীরা যেমন আছে তেমনি আছেন যুক্তিবাদী নামধারী কিছু কুলাঙ্গারও। কারণ তাঁরা জানতেন প্রবীর ঘোষ একজন ব্যক্তিমাত্র নয়, একটা আদর্শ, একটা যুগ, একটা সংগ্রামের নাম। তাই প্রবীর ঘোষকে ‘খলনায়ক’ প্রমান করতে পারলে কুঠারাঘাত করা যাবে যুক্তিবাদী চেতনার মূলে। সেই ১৯৯৬ সাল থেকে একটি গোষ্ঠী দাবী করে আসছে তিনি নাকি যুক্তিবাদী সমিতি থেকে ‘বিতাড়িত’। দাবী করে আসছে তিনি নাকি শ্লীলতাহানি, অর্থ তছরূপের অভিযোগে অভিযুক্ত৷ ভুয়ো ডিগ্রীর অধিকারী। স্ত্রীর উপর তিনি নাকি ‘নির্মম অত্যাচার’ করেন। এই সমস্ত অভিযোগে আদালতে একের পর এক মামলাও এনেছে তারা৷ একটা দুটো নয়, একের পর এক তেরোটি মামলা। কিন্তু ‘পরাজয়’ শব্দটি প্রবীর ঘোষের অভিধানে ছিল না কোনওদিনই। আদালতের লড়াইতেও জয়ী হয়েছেন তিনি। যে কটা মামলার রায় বেরিয়েছে তার প্রতিটিতেই মহামান্য আদালত তাঁকে মুক্তি দিয়েছেন সমস্ত অভিযোগ থেকে। আদালতের লড়াইতে পরাস্ত হয়ে এখন সোশ্যাল মিডিয়ায় কুৎসা রটনাকেই মূল হাতিয়ার হিসাবে বেছে নিয়েছে কুৎসাকারীরা। এটাই তাদের শেষ সম্বল। 

প্রবীর ঘোষ আজ আর নেই৷ কিন্তু তিনি বেঁচে থাকবেন তাঁর অজস্র অনুরাগীর মধ্যে৷ বেঁচে থাকবেন যুক্তিবাদী আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে৷ যতদিন ভাববাদ বিরোধী লড়াই চলবে, যতদিন অলৌকিকতা বিরোধী লড়াই চলবে, ততদিনই প্রবীর ঘোষ ধ্রুবতারা হয়ে দিক নির্দেশ করবেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনকর্মীদের। প্রবীর ঘোষরা মরেন না৷ মরে কেবল তাঁদের নশ্বর দেহটি।

লং লিভ প্রবীর ঘোষ।

যুক্তিবাদীরা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পশুবলির বিরুদ্ধে কেন? -
চিত্রদীপ সোম
Nov. 23, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:285 | likes:2 | share: 2 | comments:0

ঈদ বা এই জাতীয় উৎসব আসলে অনেক নাস্তিক বা মুক্তমনাই ধর্মীয় উৎসবে পশুবলিদানের বিরোধিতা করেন। এই নিয়ে অনেক ব্যঙ্গ টিটকিরিও সহ্য করতে হয় তাদের। অনেকেরই ধারণা যুক্তিবাদীরা ধর্ম মানেন না বলে নিজেরা অন্য সময় কবজি ডুবিয়ে মাংস খেলেও শুধুমাত্র অন্ধ ধর্ম বিরোধিতার কারণেই ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পশুবলির বিরোধিতা করেন। এটা তাদের ভণ্ডামো ও স্ববিরোধিতা ছাড়া কিছু নয়। ধর্ম পরিচয়ে মুসলিম এক বিপ্লবী এই মর্মে একটি দীর্ঘ বক্তব্য রেখেছিলেন দেখলাম। 

আসল সমস্যাটা হচ্ছে মূল বিষয়টা ধরতে না পারার ক্ষেত্রে। প্রশ্নটা পশু হত্যা বন্ধের নয়, প্রশ্নটা প্রকাশ্যে অমানবিকভাবে পশু হত্যা নিয়ে। প্রকাশ্যে এইভাবে অমানবিক পদ্ধতিতে পশুহত্যা করলে যারা দর্শক হয় তাদের মনের উপর দীর্ঘস্থায়ী খারাপ প্রভাব পড়ে। 

বিশেষ করে কোমলমতি বাচ্চাদের মনের উপর। পরবর্তীকালে তাদের নিষ্ঠুর ও অপরাধপ্রবণ হবার সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

 এই কারণে যুক্তিবাদীরা বরাবরই ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পশুবলির বিরোধিতা করে, কারন তা করা হয় হাজার হাজার লোকের চোখের সামনে। খাদ্যের কারণে পশুহত্যার বিরোধিতা কখনও যুক্তিবাদীরা করে না। এবং জেনে রাখুন ধর্মের নামে পশুবলিদানের বিরোধিতা শুধুমাত্র যুক্তিবাদীরাই করেন তা নয়, ভারতীয় আইন অনুসারেও ধর্মীয় উৎসবে পশুবলিদান সম্পুর্ন বেআইনী। 

The Prevention of Cruelty to Animals Act 1960 অনুসারে প্রকাশ্যে ধর্মের নামে পশুবলি দেওয়া রীতিমত দন্ডনীয় অপরাধ।

আইনভঙ্গকারীর জন্য ধার্য আছে জেল ও জরিমানার ব্যবস্থা (একইভাবে মাংসের দোকানগুলিতে যেভাবে প্রকাশ্যে মুরগীকে মারা হয় বা খাসীর দোকানে মৃত ছাল ছাড়ানো খাসী উলটো করে ঝুলিয়ে রাখা হয় বেআইনী সেটাও। আইন অনুযায়ী প্রতিটি স্লটার হাউসে লোকচক্ষুর আড়ালে প্রানীহত্যা করে খরিদ্দারকে তার চাহিদা অনুযায়ী মাংস প্যাকেটে ভরে দিতে হবে। এজন্য প্রতিটি স্লটার হাউসে উপযুক্ত পরিকাঠামো থাকা আবশ্যক)। কিন্তু এদেশে আর কবে আইন মেনে সবকিছু করা হয়। তাই আরো হাজার হাজার আইনের মতো এটাও এদেশে মানা হয় না যথারীতি। এবং আমরাও উদাসীন। বরং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বা আশেপাশের মাংসের দোকানে ছোটবেলা থেকে আইন না মেনে পশুহত্যা দেখতে দেখতে আমরা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি যে দিব্যি গা সওয়া হয়ে গিয়েছে আমাদের এসব। বাড়ির শিশুদেরও তাই নির্দ্বিধায় নিয়ে যাই মাংসের দোকানে। 

এই প্রসঙ্গে আরো একটা কথা বলে রাখা ভালো, ইসলাম ধর্মে পশুকে আড়াই প্যাঁচে যেভাবে হত্যা করা হয় সেটাও অবৈজ্ঞানিক ও অমানবিক। খাদ্যের জন্য পশুহত্যা করতে হলে উচিত পশুকে এক কোপে কাটা, যাতে যতদূর সম্ভব কম যন্ত্রণা দেওয়া হয়। আরো ভালো হয় হত্যার আগে অজ্ঞান করে নিলে।

আশা করা যায় বোঝাতে পেরেছি কেন কিছু মানুষ ধর্মীয় অনুষ্ঠান আসলেই পশুবলিদানের বিরোধিতা করে হইচই করেন। এরপরেও কেউ আপত্তি করলে বুঝতে হবে ধর্ম তাদের বাস্তববোধ ও সংবেদনশীলতার ভিতকে নষ্ট করে তাকে করে তুলেছে অন্ধ ধর্মীয় অনুগামীমাত্র, যাদের কাছে ধর্মের নামে সবকিছুই করা 'জায়েজ'।

প্রার্থনা বা যাগযজ্ঞে কি ফললাভ হয়? -
চিত্রদীপ সোম
Nov. 21, 2024 | যুক্তিবাদ | views:612 | likes:2 | share: 2 | comments:0

প্রার্থনা বা যাগযজ্ঞ জাতীয় জিনিসগুলি বিশ্বজুড়ে প্রচলিত সমস্ত উপাসনা ধর্মগুলিরই একটি অবিচ্ছেদ্য বৈশিষ্ট্য। বলা যেতে পারে উপাসনা ধর্মগুলি টিকেই আছে যে সমস্ত বিষয়ের উপর ভিত্তি করে তার মধ্যে অন্যতম হলো এইসব প্রার্থনা। বিভিন্ন ধর্মের প্রার্থনা পদ্ধতি বিভিন্ন। অমিলও প্রচুর। তবে একটা বিষয়ে সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে বিশ্বাসী মানুষই একমত, ঠিকমত প্রার্থনা করলে ফললাভ অবশ্যম্ভাবী। হাতে গোনা কয়েকটি ধর্ম বাদ দিলে প্রায় সমস্ত ধর্মেই ঈশ্বরের কথা বলা হয়েছে যাকে প্রার্থনায় তুষ্ট করতে পারলে তিনি মানুষের কামনা পূরণ করেন। যাগযজ্ঞ, মানত করা, ইত্যাদি এরই রকমফের।

কিন্তু ধর্মীয় প্রার্থনায় কি আদৌ ফললাভ হয়? বিশ্বাসীরা বলবেন অবশ্যই হয়। অবিশ্বাসীরা বলবেন ‘সব ঝুট’। এইসব তর্কের মীমাংসা হওয়া দুঃসাধ্য৷ তাই তর্কে না গিয়ে খোলামনে একটু দেখে নেওয়া যাক প্রার্থনায় আদৌ ফললাভ হয় কিনা।

সুরেশবাবু ব্যাংকের কর্মী৷ প্রথম সন্তান মেয়ে হবার বছর দুই পরে আবার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী মিনতিদেবী। সুরেশবাবুর একান্ত ইচ্ছা এবার একটি ছেলের মুখ দেখার। পাড়ার এক বয়স্কা মহিলার পরামর্শ মতো এক 'জাগ্রত' কালীর থানে মানত করলেন সুরেশবাবু পুত্রসন্তানের জন্য। এর কয়েকমাস পরেই স্ত্রীর প্রসববেদনা উঠলো। মিনতিদেবীর কোল আলো করে এলো এক ফুটফুটে পুত্রসন্তান। মায়ের কৃপায় বিগলিত সুরেশবাবু সেই সপ্তাহেই ছুটলেন মানত পূর্ণ করতে।

মাঝবয়সী বিজনবাবু ইদানীং খুব গ্যাস অম্বলে ভুগছেন। ওষুধ খেয়েও বিশেষ কিছু কাজ হচ্ছে না৷ অফিসের দত্তদার পরামর্শ অনুযায়ী হুগলীর এক বিখ্যাত ঠাকুরের চরণামৃত পরপর তিনদিন সকালে খালিপেটে খেলেন বিজনবাবু। আর তারপরেই ম্যাজিক। গ্যাস অম্বল যেন মন্ত্রবলে অনেকটাই কমে গেলো!  ঠাকুরের এহেন কৃপায় বিজনবাবু একটি ছবি বাঁধিয়ে রেখেছেন ঠাকুরঘরে।নিত্য এখন সেই ছবিতে ফুলমালা দেন তিনি।

প্রদীপ বছর ছাব্বিশের এক বেকার যুবক। অনেক চাকরির পরীক্ষায় বসেছে। কিন্তু বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়েনি। বাড়ির লোক অনেকবার বলেছে ভালো দেখে একটা পুজো দিতে ঠাকুরের কাছে। কিন্তু যুবক প্রদীপ রক্তের জোরে সে সবকে এতদিন উপহাসই করে এসেছে। অবশেষে একদিন বাড়ির পীড়াপীড়িতে ঠাকুরের কাছে পুজো দিয়ে বুক পকেটে প্রসাদি ফুল বেলপাতানিয়ে চাকরির পরীক্ষায় বসলো প্রদীপ। আর এবারেই বাজিমাত! লিষ্ট বেরোতে দেখা গেলো জ্বলজ্বল করছে প্রদীপের নাম।

উপরের ঘটনাগুলির মতো ঘটনা অহরহ হয়ে চলেছে আমাদের চারপাশে। আর এগুলোকে হাতিয়ার করেই দৈব বিশ্বাসীরা প্রশ্ন তুলে দেন যুক্তিবাদীদের দিকে। প্রার্থনায় যদি ফললাভ নাই হবে তাহলে উপরের ঘটনাগুলির ব্যাখ্যা কি? আছে এসবের কোনো উত্তর অবিশ্বাসী নাস্তিকদের কাছে?

বিষয়টিকে ভালোভাবে বুঝতে উপরের ঘটনাগুলির কাটাছেঁড়ায় আসা যাক এবার। কিভাবে পূরণ হয়েছিলো উপরের প্রার্থনাগুলি? আসলে প্রার্থনায় সেইসব চাহিদাই পূরণ হয় যেগুলো এমনিতেও পূরণ হওয়া সম্ভবপর ছিলো। মাঝখান থেকে নাম হয় প্রার্থনার। 


আপনি যদি উপরের দিকে একটা কয়েন ছুঁড়ে প্রার্থনা করেন হেড পড়ার তাহলে প্রার্থনায় ফল লাভের সম্ভাবনা ৫০%। প্রার্থনা না করলেও হেড পড়ার চান্স ছিলো ওই ৫০%-ই

কিন্তু প্রার্থনা করায় নাম হয়েছে প্রার্থনার। কিন্তু আপনি যদি কয়েন ছুঁড়ে প্রার্থনা করেন হেড ও টেল উভয়ই একইসাথে পড়ার তাহলে আপনার প্রার্থনা পূরণ হবার সম্ভাবনা ০%, সে আপনি যতই ভক্তিভরে আপনার ঈশ্বরকে ডাকুন না কেন৷ কারণ বাস্তবত হেড ও টেল একইসাথে পড়া সম্ভব নয়৷ একইভাবে আপনি যদি ভারত পাকিস্তান খেলার সময় আপনার ভগবানকে ডাকেন আপনার দেশকে জেতানোর জন্য, যাগযজ্ঞ করেন এই উদ্দেশ্যে, তাহলেও আপনার প্রার্থনা পূরণ হবার সম্ভাবনা ৫০%। কিন্তু আপনি যদি প্রার্থনা করেন দুটো দেশই জেতার তাহলে আপনার প্রার্থনা পূরণ হবার সম্ভাবনা ০%।  কারণ দুটো দেশের একসাথে জেতা বাস্তবে সম্ভব নয়।

উপরের উদাহরণগুলিতেও তাই হয়েছে। সুরেশবাবু মানত না করলেও তার পুত্রসন্তান হতে পারত। মানত করায় নাম হয়েছে মানতের৷ বিজনবাবু একইসাথে চরণামৃতও খেয়েছেন আবার ওষুধও খেয়েছেন। রোগ সারায় নাম হয়েছে চরণামৃতের। শুধু বিজনবাবু নন, অধিকাংশ রোগীই এটা করেন। আধুনিক চিকিৎসা ও দৈব পদ্ধতি উভয়েরই সাহায্য গ্রহন করেন। রোগ সারলে নাম হয় দেবতার। আর না সারলে 'ডাক্তারের ব্যর্থতা'।  

আজ অবধি কোনো ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষকেই দেখিনি ঈশ্বরের ক্ষমতার উপর ভরসা করে চিকিৎসা না করিয়ে কেবল প্রার্থনা বা চরণামৃত বা মাদুলি তাবিজের ভরসায় পড়ে থাকতে। এটাই এদের ভন্ডামি।

অবশ্য কোনো কোনো ক্ষেত্রে ওষুধ না খেয়ে কেবল চরণামৃত খেয়েও রোগ সারতে পারে। বিজ্ঞানসম্মত কারণও আছে তার। যে কোনো চিকিৎসক মাত্রেই জানেন আমাদের দেহের অনেক রোগই সারানো যায় কোনো ওষুধ ছাড়াই কেবল মনের বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে। যাকে placebo effect বলেন চিকিৎসকরা। আজকের আলোচনায় এনিয়ে বিস্তারিত কথা বলার অবকাশ নেই, পরে কোনোদিন সুযোগ হলে বলব। আপাতত শুধু এটুকু জেনে রাখুন কেবলমাত্র মনের বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়েই গ্যাস, অম্বল, হাঁপানি, নানা স্থানে ব্যাথা ইত্যাদি নানাপ্রকার রোগেরনিরাময় বা প্রশমণ সম্ভব৷ বহুক্ষেত্রে সাইকো-সোম্যাটিক রোগ(মন জনিত দেহের রোগ) সারাতে প্ল্যাসিবো এফেক্টের ব্যবহারও করেন ডাক্তারবাবুরা। আসলে চরণামৃতের ঔষধিগুন নয়, এক্ষেত্রে চরণামৃতের প্রতি রোগীর বিশ্বাসই তাকে সুস্থ হতে সাহায্য করেছে। প্রদীপের ঘটনাটির ব্যাখ্যাও একই। ফুল বেলপাতা ছাড়াও প্রদীপের সফল হবার সম্ভাবনা ছিলোই। কিন্তু সফল হওয়ায় নাম হয়েছে ঠাকুরের কৃপার।

তাহলে কিভাবে 'মিথ্যা' প্রমান করা যাবে প্রার্থনার শক্তিকে? খুব সোজা। এমন কিছু প্রার্থনা করুন যেগুলো এমনিতেই সফল হবার সম্ভাবনা 'শূন্য'। তাহলেই দেখবেন ঈশ্বর আর সাড়া দিচ্ছেন না প্রার্থনায়। তা সে যত 'জাগ্রত' দেবতাই হোক। যেমন আপনি আপনার মনোমত যে কোনো দেবতার কাছে কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করুন ভারত যেন আগামী অলিম্পিকে সবচেয়ে বেশী পদক লাভ করে। দেখবেন প্রার্থনায় আর কোনো ফল হচ্ছে না৷ ভারত পদকতালিকায় পড়ে থাকছে সবার শেষেই। কিম্বা প্রার্থনা করুন ভারত যেন আগামী দশ বছরের মধ্যে ফুটবলে বিশ্বকাপ জেতে। দেখবেন কালী বা আল্লা বা গড কোনো ঈশ্বরই আর প্রার্থনা পূরণ করছেন না৷ কিম্বা প্রার্থনা করুন আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে যেন ভারত থেকে সমস্ত দারিদ্র, অনাহার ও বেকারীত্ব দূর হয়ে যায়। এবারও দেখবেন কোনো ঈশ্বরই আর সাড়া দিচ্ছেন না আপনার প্রার্থনায়। কারণ এই দাবীগুলো বাস্তবে মেটা সম্ভব নয়। ওই হেড আর টেল একসাথে পড়ার মতই। আর তাই এখানে প্রার্থনার শক্তিও 'ফেল' করে যায়। এটাই বাস্তব।

অর্থাৎ এই আলোচনা থেকে প্রমাণিত প্রার্থনায় ফলে কেবল সেইসব দাবীগুলোই যেগুলো এমনিতেও ফলার সম্ভাবনা ছিলো। প্রার্থনার ভূমিকা তাই বাস্তবে শুন্য।

এরপরও যদি কেউ প্রার্থনার শক্তিনিয়ে কুতর্ক করতে আসেন তাহলে তার কাছে উদাত্ত আহ্বান থাকবে প্রার্থনার সাহায্যে আগামী দশ বছরের মধ্যে ভারতকে ফুটবলে বিশ্বকাপ জেতানোর বা প্রার্থনার সাহায্যে পাঁচ বছরের মধ্যে দেশ থেকে সমস্ত দারিদ্র, অনাহার, বেকারত্ব দূর করতে পারার। যদি পারেন, তাহলে যে কোনো কট্টর নাস্তিকও মেনে নেবে ধর্মীয় প্রার্থনায় সত্যিই ফললাভ হয়। আর যদি না পারেন তাহলে মেনে নিন প্রার্থনা কেবল মনের শান্তি বিশেষ। বাস্তব কোনো ফলপ্রদান সম্ভব নয়। কোনো ঈশ্বরবিশ্বাসী মানুষ চাইলেই এই চ্যালেঞ্জ নিয়ে নাস্তিকদের মুখে ঝামা ঘষে দিতে পারেন। খোলা আহ্বান রইলো সমস্ত ঈশ্বরবিশ্বাসী, প্রার্থনার শক্তিতে বিশ্বাসী মানুষদের কাছে।

দেশপ্রেম: একটি উপযুক্ত সংজ্ঞার খোঁজে -
চিত্রদীপ সোম
Nov. 21, 2024 | রাজনীতি | views:282 | likes:2 | share: 2 | comments:0

হয়ত বড় অসময়ে এ লেখায় হাত দিয়েছি। বা হয়ত এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। সবে পনেরই আগষ্ট গেল। দেশপ্রেমের ঝড় প্রত্যক্ষ করেছি দু’দিন আগেই। বাইকে, গাড়িতে, বাড়ির মাথায় পতাকায় পতাকায় ছয়লাপ। মাইকে  দেশাত্মবোধক সঙ্গীত। টিভিতে ‘সারে জাঁহা সে আচ্ছা’ গানের সাথে ভারী বুটের কুচকাওয়াজ আর আকাশে যুদ্ধ বিমান থেকে পুস্পবৃষ্টি। দেখতে দেখতে ভারী আরাম বোধ করি। অনুভব করি এই তো আমার দেশ। ওই যে সার দিয়ে যাওয়া ট্যাঙ্কের সারি, ওই যে কম্যাণ্ডের তালে তালে সারিবদ্ধ বুটের আওয়াজ, ওই যে মিলিটারি গাড়ির মাথায় রাখা স্বয়ংক্রিয় ক্ষেপনাস্ত্র, এটাই তো আমার দেশ। ওই যে টিভিতে দেখাচ্ছে দেশের সেনা একমুঠো মাটি হাতে নিয়ে প্রতিজ্ঞা করছে শত্রুসৈন্যকে খতম করে দেবার, আর তারপর এগিয়ে যাচ্ছে রণক্ষেত্রে, এটাই তো আমার দেশ। ওই যে রৌদ্রোজ্জ্বল আকাশে পতপত করে উড়তে থাকা তেরঙা পতাকা, ওটাই আমার দেশ।

কে দেশপ্রেমিক নয় আজকের দিনে? সাতে পাঁচে না থাকা হরিপদ কেরানী শ্যামলবাবু, দু’নম্বরি ওষুধের ব্যবসায়ী রমেশবাবু, আয়কর দপ্তরে কাজ করা দু’হাতে ঘুষ নেওয়া অনিলবাবু, স্থানীয় মস্তানদের থেকে তোলা আদায়কারী, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের পদলেহনকারী পুলিশ অফিসার সুনীলবাবু, পণের দায়ে বউকে ধরে পেটানো স্বরূপবাবু, বাড়ির ইলেকট্রিক মিটারে কারচুপি করে রাখা সুব্রতবাবু, বাড়ির শিশু গৃহশ্রমিককে খুন্তির ছ্যাঁকা দেওয়া অনিতা দেবী, সবাই সবাই দেশপ্রেমিক আজ। দেশপ্রেম আজ এতটাই সস্তা, এতটাই সহজলভ্য। দেশপ্রেমিক হবার জন্য আজ আর দেশের জন্য কিছু না করলেও চলে। দেশের মানুষের জন্য জীবনপাত না করলেও চলে। কেবল বুকে বা বাইকে পতাকার স্টিকার লাগিয়ে ঘোরা, টিভিতে মিলিটারি বুটের আওয়াজ বা মাইকে ‘অ্যায় মেরে বতন কে’ শুনে বুকের মধ্যে ছলাৎ ছলাৎ করে ওঠা আর দুপুরে টিভিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের খান দুই গরম গরম সিনেমা দেখলেই দেশপ্রেমিক হবার কোটা সম্পুর্ন। আর তাই দেশপ্রেমিক হবার এই সহজ প্রতিযোগিতায় কেউ পিছিয়ে নেই আজ।


আর দেশপ্রেমের এত বিচিত্র আয়োজনে গুলিয়ে যায় একটা সোজা প্রশ্ন, কাকে বলবো দেশ, কাকে বলবো দেশের প্রতি প্রেম।

দেশ কী? তা কি শুধুই কাঁটাতারে ঘেরা একটা ভূখন্ড? শাসকের মগজধোলাইয়ের শিকার অধিকাংশ মানুষের কাছে দেশ মানে তাই-ই৷  কাঁটাতারে ঘেরা এক ভৌগলিক এক সীমানা মাত্র। এক রঙিন মানচিত্র। আর সেই ভৌগলিক সীমানাকে অখন্ড রাখতে চাওয়াই দেশপ্রেমের একমাত্র সংজ্ঞা আজ মানুষের কাছে৷ এবং এর জন্য সাধারণ মানুষকে একটুও দোষ দেওয়া যায় না, কারণ বহু ঢক্কা নিনাদে, বহু ব্যায় করে মিডিয়া, স্কুল পাঠ্যপুস্তক থেকে পোষ্য নানা বুদ্ধিজীবীদের দিয়ে ইনিয়ে-বিনিয়ে সরকার জনগনের মাথার মধ্যে দেশপ্রেমের এই সংজ্ঞাই ঢুকিয়ে দিতে চায়। বোঝাতে চায় দেশ মানে কেবল কাঁটাতারে একটা ভূখন্ডমাত্র। আর সেই ভূখন্ডের রক্ষকরাই দেশের আসল সেবক। দেশের সীমানাকে যেনতেন প্রকারে অক্ষুন্ন রাখাই একমাত্র দেশপ্রেমের মাপকাঠি।

কিন্তু কেউ যদি শাসকের মগজধোলাইয়ের শিকার না হন, যদি সেই বিরল কিছু মানুষের মধ্যে পড়েন যারা স্বাধীনভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা রাখেন, তাহলে অনুধাবন করবেন শুধু সীমানা দিয়ে দেশের ব্যখ্যা হয় না৷ দেশ মানে সেই সীমানার মধ্যে অবস্থিত সমস্ত জনগোষ্ঠী, সমস্ত প্রাকৃতিক সম্পদ, সমস্ত উদ্ভিদ ও প্রানী, সবকিছুই। আর তাই দেশপ্রেম মানে কেবল দেশের মাটি বা সীমানার প্রতি প্রেম নয়, “দেশপ্রেম মানে দেশের মানুষের প্রতি প্রেমও”। মানুষ ছাড়া দেশ অর্থহীন। মানুষই তৈরী করে এক দেশের সাথে অন্য দেশের সীমানা। পৃথিবীতে যখন মানুষ আসেনি, প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসররা যখন ঘুরে বেড়াত পৃথিবীর বুকে, তখন কোনটা ছিলো ভারত, কোনটা ছিলো পাকিস্তান, কোনটাই বা ছিলো রাশিয়া? আবার হঠাৎ করে যদি মানুষ বিলুপ্ত হয়ে যায় দুনিয়া থেকে তখন কে বলে দেবে কোনটা ভারত আর কোনটা পাকিস্তান? এই যে কাঁটাতারে ঘেরা এই পৃথক পৃথক ভূখন্ডের ধারণা, এটা তো মানুষেরই সৃষ্টি। সেই মানুষই  যদি না থাকে তাহলে কী হবে সেই দেশ নিয়ে?

অথচ আজ শাসকগোষ্ঠী দেশপ্রেমের যে সংজ্ঞা আমাদের মাথায় ঢোকাতে চাইছে তাতে দেশের সীমানার কথা আছে, সীমান্তরক্ষাকারী প্রহরীদের কথা আছে, নেই কেবল দেশের মানুষের কথা। নেই রামা কৈবর্ত্য আর হাসিম শেখদের কথা। দেশপ্রেমিক বলতে আমাদের চোখে ভেসে ওঠে সীমান্ত রক্ষাকারী সৈন্যদের কথা, কিন্তু ভেসে ওঠে না রামা কৈবর্ত্য  বা হাসিম শেখদের কথা, যারা রোদ ঝড় মাথায় নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে ফসল ফলায়, আমাদের মুখে অন্ন তুলে দেয়। ভেসে ওঠে না হাবিব মোল্লা বা কালু প্রামাণিকদের কথা, যারা কারখানায় হাতুড়ি পিটিয়ে সচল রেখেছে এ দেশের অর্থনীতিকে।


সৈন্যদের পেশার প্রতি আবেগে গদগদ ভাবকে কিছুক্ষনের জন্য ছুটি দিয়ে ভাবুন তো, দেশকে সচল রাখতে কার অবদান বেশী, একজন সৈন্যের, না একজন কৃষকের? একজন সৈন্যের, না একজন শ্রমিকের? আজ সারা পৃথিবী থেকে সৈন্যবাহিনী তুলে দিলেও পৃথিবী যেমন চলছে তেমনই চলবে। কিন্তু আজ যদি সারা পৃথিবীর কৃষকরা চাষ করা বন্ধ করে দেয়? যদি সারা পৃথিবীর শ্রমিকরা সমস্ত কারখানা বন্ধ করে দেয়? যদি সারা পৃথিবীর স্বাস্থ্যকর্মীরা পরিষেবা দেওয়া থামিয়ে দেয়? ভাবতে পারছেন কী হবে তারপরে?  চলবে তো তারপর পৃথিবী স্বাভাবিকভাবে? নাকি এক অবশ্যম্ভাবী বিপর্যয়ের মুখে এসে দাঁড়াবে তা? দেশকে সচল রাখতে কে বেশী গুরুত্বপূর্ণ তাহলে?


তাহলে টিভিতে, মিডিয়ায় কেন দেশপ্রেমের নিদর্শন হিসাবে ঠাঁই পায় শুধু উর্দিধারী সীমান্তরক্ষীরা? কেন রামা কৈবর্ত্য বা হাবিব মোল্লারা নয়? কেন তারা সিনেমায়, গানে, কুচকাওয়াজে, কাব্যে সর্বত্র উপেক্ষিত? কেন সীমান্তে মৃত সেনারা শহীদের সন্মান পায়, কিন্তু চাষ করতে গিয়ে বজ্রপাতে বা সর্পাঘাতে মৃত কৃষকরা থেকে যায় উপেক্ষিত? কেন সৈন্য মারা গেলে আবেগে ছলছল করে ওঠে আমাদের চোখ, কিন্তু দেনার দায়ে গত পাঁচ বছরে প্রায় দেড় লক্ষ কৃষক মৃত্যুর খবর বিন্দুমাত্র ঝড় তোলে না আমাদের হৃদয়ে? কেন এদেশে সীমান্ত রক্ষার জন্য কোটি কোটি টাকার অস্ত্র আসে, বিদেশ থেকে যুদ্ধ বিমান কেনা হয়,  কিন্তু রামা কৈবর্ত্য বা হাসিম শেখরা যাতে ভালো থাকে, তাদের পেটে যাতে দুবেলা খাবার জোটে, তার ব্যবস্থা করা হয় না? কেন আজ ভারত পৃথিবীর অন্যতম সামরিক শক্তিধর দেশ হওয়া সত্ত্বেও আজও ভারতের হাজার হাজার গ্রাম বিদ্যুতহীন? কেন আজ ভারতের কাছে রাফায়েল কেনার টাকা থাকে, কিন্তু থাকে না প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে নূন্যতম স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার টাকা? কেন ভারতের পরমানু বোমা পরীক্ষার টাকা থাকে, অথচ থাকে না প্রত্যন্ত গ্রামগুলিতে শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলার টাকা? মানুষের মুখে খাবার না দিয়ে, মানুষের নুন্যতম চিকিৎসার ব্যবস্থা না করে, মানুষের শিক্ষার ব্যবস্থা না করে যারা হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে যুদ্ধাস্ত্র কেনে, যারা স্বাস্থ্য ও শিক্ষাখাতে ব্যয় বরাদ্দ কমাতে কমাতে ১% এর কাছাকাছি নিয়ে আসে, যারা নোট বাতিল, জিএসটি সহ নানা উদ্ভট পরীক্ষানিরীক্ষার মাধ্যমে ৪০% ছোট ব্যবসাকে ধ্বংস করে অসংখ্য পরিবারকে ঠেলে দেয় বিপদের মুখে, যারা একের পর এক সরকারী সংস্থাগুলিতে তুলে দেয় বেসরকারি হাতে, যারা ছাঁটাইয়ের খাড়া নামিয়ে এনে হাজার হাজার পরিবারকে ঠেলে দেয় ধ্বংসের পথে, এভাবে দেশের মানুষের জীবনকে যারা করে তোলে সঙ্গীন, তারা যে আদৌ 'দেশপ্রেমিক' নয় বরং 'দেশের শত্রু' এটা কবে বুঝবো আমরা? কবে কাটবে আমাদের চিন্তাধারার এই অস্পষ্টতা? দেশের শত্রু মানে কি কেবল পাকিস্তান? যাদের জন্য আজ দেশের মানুষের এই চরম দুরবস্থা তারা দেশের শত্রু নয়? আর যদি তাই হয় তাহলে তাদের বিরোধিতা করাটা, তাদের মুখোশ উন্মোচন করাটা কেন দেশপ্রেম নয়? এদের বিরুদ্ধে মানুষকে তাদের অধিকার বুঝে নেবার লড়াইতে উদ্বুদ্ধ করাটা কেন দেশপ্রেম নয়?

দেশপ্রেম মানে শুধু সীমান্ত পাহাড়া দেওয়া নয়, মানুষকে তার অধিকার আদায়ের লড়াইতে উদ্বুদ্ধ করাটা, রাষ্ট্রীয় মগজ ধোলাইয়ের কুহেলিকা থেকে মানুষকে  বের করে এনে মুক্ত মনে চিন্তা করতে শেখানোটাও দেশপ্রেম, দেশের মানুষের জন্য ক্ষেতে ফসল ফলানোটাও দেশপ্রেম, কারখানায় হাতুড়ি পেটানোটাও দেশপ্রেম, হাসপাতালে রাত জেগে মুহুর্ষু রোগীর সেবা করাটাও দেশপ্রেম। দেশ শুধু সীমান্তের কাঁটাতার আর সৈন্য দিয়ে তৈরী নয়, দেশ আরো অসংখ্য সাধারণ মানুষ দিয়েও তৈরী। সেইসব মানুষের সেবা করাটা, তাদের জাগতিক ও মানসিক উন্নতির চেষ্টা করাটাই প্রকৃত দেশপ্রেম। আর সাধারণ মানুষের ক্ষতি হয় এমন কাজ করটাই দেশদ্রোহীতা। এই সহজ সরল উপলব্ধিটা যতক্ষন না হবে ততক্ষন রাষ্ট্রীয় মগজধোলাইয়ের পুতুলই থেকে যাবেন আপনি।

বর্তমানে দেশপ্রেমিক হবার আর এক সহজ পথ পাকিস্তানকে তেড়ে গাল দেওয়া। আমরা ভুলে যাই নিজের মায়ের প্রতি ভালোবাসা প্রমান করার রাস্তা পাশের বাড়ির ভদ্রলোকের মা-কে তেড়ে গাল পাড়া নয়। আপনি নিজের মা-কে ভালোবাসেন সেটা তখনই প্রমানিত হবে যখন আপনি আপনার রোজগারের টাকা দিয়ে মায়ের জন্য পুষ্টিকর খাবার কিনে আনবেন, তার জন্য সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন, তার জন্য ভালো জামা কাপড় কিনে আনবেন। তখনই কেবল আপনাকে মায়ের সুসন্তান বলা যাবে। মায়ের প্রতি আপনার ভালোবাসা তখনই একমাত্র পরীক্ষার মানদন্ডে উত্তীর্ণ হবে। তার বদলে আপনার রোজগারের টাকায় যদি আপনি মায়ের জন্য খাবার না কিনে, তার অত্যাবশ্যক ওষুধ না কিনে, সেই টাকায় চকচকে ভোজালি কেনেন পাশের বাড়ির ভদ্রলোকের মা কে খুন করার জন্য, তাহলে সেটা আর যাই হোক মার্তৃপ্রেম বা মাতৃভক্তি নয়। নিজের মায়ের প্রতি ভালোবাসা প্রমানিত হয় না তাতে। বদলে এইটুকু প্রমানিত হয় কোনো কারণে পাশের বাড়ির ভদ্রলোকের মাকে ঘৃণা করেন মাত্র। ব্যাস।

ঠিক একইভাবে শুধু পাকিস্তানকে ঘৃণা করলেই বা দেশের সেনার প্রতি ভক্তিতে গদগদ হলেই আদৌ আপনি দেশপ্রেমিক হচ্ছেন না বা দেশের প্রতি আপনার দায়িত্ব শেষ হয়ে যাচ্ছে না। নিজের দেশের মানুষের প্রতি ইতিবাচক কিছু করার দায়িত্বও একইভাবে থেকে যাচ্ছে। সেটা যতক্ষন না সুষ্ঠুভাবে করছেন ততক্ষন বুকে বা বাইকে যতই তেরঙা স্টিকার লাগান, আর মাইকে অ্যায় মেরে বতন কি লোগো শুনে রক্ত গরম হোক, ওটা ভণ্ডামি ছাড়া কিছু নয়।


শাসকের শেখানো ছদ্ম দেশপ্রেমের মগজধোলাইয়ের হাত থেকে তাই মুক্ত হই আসুন। আবেগ বিবর্জিতভাবে শিখে নিই কাকে বলে দেশ, কাকে বলে দেশপ্রেম। বুঝে নিই দেশ মানে শুধু দেশের মাটি নয়, দেশের মানুষও। দেশকে ভালোবাসা মানে শুধু সীমান্ত আর সেনাকে ভালোবাসা নয়, দেশকে ভালোবাসার প্রকৃত অর্থ দেশের মানুষকে ভালোবাসা, তার জীবনসংগ্রামে পাশে থাকা, তার অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে সহযোদ্ধা হওয়া৷

এই বোধ ছাড়া অসম্পূর্ণ থেকে যায় দেশপ্রেম।

আত্মার অস্তিত্ব কি সত্যিই আছে? ভূত কি বাস্তব? নাকি পুরোটাই কুসংস্কার? -
চিত্রদীপ সোম
Nov. 20, 2024 | যুক্তিবাদ | views:818 | likes:2 | share: 2 | comments:0

আত্মা নিয়ে যুগ যুগ ধরে মানুষের কৌতুহলের শেষ নেই৷ সেই প্রাচীন যুগ থেকেই অনন্ত রহস্যের আধার এই বিষয়টি। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে বিভিন্ন বর্ণনা দেওয়া হয়েছে আত্মার। তাছাড়াও আছে প্রচলিত ও লোকায়ত নানা বিশ্বাস। আসুন আজ এসব নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক মুক্ত মনের আলোয়। 

আত্মা কী?  

সংক্ষেপে বলা যায় মানুষ ও অনান্য প্রানীর শরীরে থাকা যে অতিপ্রাকৃত শক্তি মানুষ তথা অন্য প্রানীর জীবিত থাকার জন্য দায়ী, তাই-ই হলো আত্মা। একটা জীবিত প্রানী নড়তে পারে, শব্দ করতে পারে, স্থানান্তরিত হতে পারে, যা একটা জড়বস্তু বা একটা মৃতদেহ পারে না৷ আস্তিকরা একেই নাম দিয়েছেন আত্মা। এমনকি উদ্ভিদের মধ্যেও আত্মা আছে, যদিও তাদের মধ্যে প্রানীর লক্ষনগুলো দেখা যায় না। 

আত্মার অস্তিত্ব সত্যি আছে কিনা বা আত্মা সম্পর্কে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থগুলো কী বলেছে তা নিয়ে আলোচনায় ঢুকবার আগে একটু দেখে নি আত্মার উৎপত্তি মনুষ্যসমাজে কবে থেকে।

প্রকৃতপক্ষে মানুষের মধ্যে আত্মার ধারণা সংগঠিত ধর্মগুলির চেয়ে অনেক প্রাচীন। এমনকি তা ঈশ্বরবাদের আবির্ভাবের চেয়েও প্রাচীন৷ ঈশ্বরবিশ্বাস মানুষের মধ্যে অস্পষ্ট রূপে প্রথম আসতে শুরু করে নিয়ান্ডারথাল মানবের সময় থেকে, যা প্রায় পাঁচলক্ষ বছরের পুরানো৷ কিন্তু আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস আরো আগে। কত আগে? সে বিষয়ে সঠিক তথ্য আমরা কেউই জানি না৷ তবে পন্ডিতেরা বলছেন অন্তর তারো দশ হাজার বছরের পুরানো তো হবেই (এগুলো নিয়ে যদিও বিভিন্ন পরস্পরবিরোধী তথ্য ও তত্ত্ব আছে)। সম্ভবত আদিম প্রাইমেট থেকে যখন 'বুদ্ধিমান' বিভিন্ন আদিম মানব প্রজাতির উদ্ভব ঘটতে শুরু করেছিলো, আত্মার কল্পনাও তখন থেকেই মানবসমাজে (যদি সেটাকে 'সমাজ' নাম দেওয়া যায়) শুরু হয়। 

কোন ঘটনা মানুষকে সাহায্য করেছিলো আত্মার অস্তিত্বের কথা ভাবতে? 

এ’ব্যাপারে দুটো জিনিসের কথা পন্ডিতরা তুলে ধরেছেন। এক, আদিম মানুষ লক্ষ করেছিলো জীবন্ত প্রানীর সাথে মৃত প্রানীর বা জড়বস্তুর পার্থক্য আছে। কিন্তু সেই পার্থক্য কিসের কারণে সেটা বৈজ্ঞানিকভাবে ব্যাখ্যা করার মতো উপায় তাদের মধ্যে ছিলো ন। ফলে তারা ধারণা করে নেয় 'অলৌকিক' কোনো শক্তিই এর পিছনে দায়ী৷ আর দ্বিতীয় কারণটি হলো স্বপ্ন৷ স্বপ্নে আদিম মানুষরা দেখতো তারা বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াচ্ছে, বিভিন্ন কাজ করছে যেগুলো তারা কখনো করে নি। ফলে তাদের ধারণা হয় দেহের মধ্যে কোনো শক্তিই এগুলোর জন্য দায়ী। ঘুমন্ত অবস্থায় সেই শক্তি শরীর থেকে বেরিয়ে গিয়ে এসব কাজ করে আবার ঘুম ভাঙার আগে ফিরে আসে। এটাই হলো আত্মা প্রাথমিক ধারনা৷ কোনো কোনো পন্ডিত এর সাথে জুড়ে দিচ্ছেন রোগের ধারণাকেও। কেন বিভিন্ন রোগ হচ্ছে তা ব্যখ্যা করার উপায় আদিম মানুষের কাছে ছিলো না। ফলে তাদের ধারণা হয় বহিরাগত কোনো খারাপ শক্তি এসে তাদের শরীরের মধ্যের শক্তিটাকে দুর্বল করে দিচ্ছে। এইবকারণেই রোগবাগ হয়৷ রোগ সারাতে ওঝা ডাকার প্রচলন এই সময় থেকেই শুরু হয় আদিম মানুষের মধ্যে। আদিম বিভিন্ন গুহাচিত্রে অদ্ভুতুড়ে পোষাক পরে নৃত্যর‍ত যেসব মানুষগুলোকে দেখেন, তারাই মানবসমাজের প্রথম ওঝা। ধর্ম বা পুরোহিতের আগমন তখনও হয় নি সমাজে।

 আরো একটা কৌতুহলকর বিষয়, মানুষ এইসময় মনে করতো গাছপালা, নদীনালা, পাহাড়পর্বত, সূর্য চাঁদ প্রত্যেকেরই প্রান অর্থাৎ আত্মা আছে। তাই এসব প্রাকৃতিক শক্তিতে তুষ্ট করার জন্য, অর্থাৎ তাদের আত্মাকে তুষ্ট করার জন্য তারা এসব প্রাকৃতিক শক্তির পুজো করতো৷ মনে রাখবেন, হিন্দুদের প্রকৃতিবাদের সাথে এই বিশ্বাসের পার্থক্য আছে। হিন্দুরা বায়ুর দেবতা বলে মনে করে পবনদেবকে। জলের দেবতা বলে মনে করে বরুনকে। তাই হিন্দুরা ঠিক বায়ু বা জলকে পুজো করে না, করে এইসব প্রাকৃতিক শক্তি গুলোর দায়িত্বে থাকা দেবতাদের, অর্থাৎ পবন বা বরুণকে৷ কিন্তু আদিমমানুষেরা তা করত না। তারা সরাসরি এসব বায়ু বা জলকেই জীবন্ত প্রানী হিসাবে পুজো করতো (সম্ভব হলে ধর্ম ও জাদুবিশ্বাসের বিবর্তন নিয়ে পরে একদিন কলম ধরবো)।

এই গেলো আত্মার উদ্ভবের ইতিহাস৷ এবার আশা যাক আত্মা সম্পর্কে কোন ধর্মমত কী বলেছে।এবং এখান থেকেই গ্যাঁড়াকলের শুরু। কারো বর্ণনার সাথে কারো বর্ণনা মেলে না, অথচ সবাই মনে করে তার ধর্মের ব্যখ্যাটাই সঠিক। কেন সঠিক তার অবশ্য কোনো ব্যাখ্যা নেই বিশ্বাসীদের কাছে। সঠিক, ব্যাস।

প্রথমে গীতার কথাতেই আসা যাক। গীতায় বলা হয়েছে


বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়।

নবানি গৃহ্ণাতি নরোহপরাণি।।

তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণা।

ন্যন্যনি সংযাতি নবানি দেহি।।

নৈনং শস্ত্রাণি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ।

ন চৈনং ক্লেদায়মত্যাপো ন শোসষয়তি মারুতঃ।।

অচ্ছেদ্যহয়মদাহ্যোহয়মক্লেদ্যোহশপষ্য এব চ।

নিত্যঃ সর্বগতঃ স্থানুরলচোহয়ং সনাতনঃ।।

অব্যক্তহয়মচিন্ত্যোহয়মবিকার্যোহয়মুচ্যতে।

তস্মাদেবং বিদিত্বৈনং নানুশোচিতুমহর্সি।।

(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ, ২/২২-২৫)

মানেটা কী দাঁড়ালো? 

মানুষ যেমন ছিন্ন বস্ত্র ছেড়ে নতুন বস্ত্র পরে, আত্মা তেমমই পুরানো শরীর ত্যাগ করে নতুন শরীরে প্রবেশ করে।  এই আত্মাকে কোনো অস্ত্র দ্বারা কাটা যায় না, আগুন তাকে পোড়াতে পারে না, জল ভেজাতে পারে না, বাতাস শুকাতে পারে না। এ হলো শাশ্বত, স্থির ও সনাতন।

 মৃত্যুর পর আত্মা তাহলে কোথায় যায়?  প্রাচীন হিন্দুরা বিশ্বাস করতো মৃত্যুর পর ভালো আত্মার স্থান হয় ব্রহ্মলোকে, অর্থাৎ প্রজাপতি ব্রহ্মার রাজ্যে। আর খারাপ আত্মার স্থান হয় নরকে। পরবর্তীকালে হিন্দুদের মধ্যে এলো কর্মফল তত্ত্ব। হিন্দুরা বিশ্বাস করতে শুরু করলো মানুষের এ জীবনের কর্মফল অনুযায়ী পরবর্তী জন্ম নির্ধারিত হবে তার। অর্থাৎ ভালো কাজ করলে ব্রাহ্মণ জন্ম, খারাপ কাজ করলে বৈশ্য বা শূদ্র জন্ম, এবং আরো খারাপ কাজ করলে কীটপতঙ্গের জন্ম। প্রথমদিকে সমাজের অনুশাসন বজায় রাখতে, গোষ্ঠী জীবনের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এই কর্মফলবাদের উদ্ভব হয়৷ পরবর্তীকালে তাই হয়ে দাঁড়ায় শ্রেনী শোষনের অস্ত্র৷ জাতিভেদ প্রথা টিকিয়ে রাখার অস্ত্র। সমস্ত অধিকার থেকে বঞ্চিত শূদ্রদের মাথায় ঢোকানো হয় এ জীবনে তাদের উপর এত অত্যাচার, এত শোষণ নিপীড়নের কারণ তাদের পূর্বজন্মের কর্মফল। পূর্বজন্মে তারা অনেক পাপ করেছিলো, তারই শাস্তি হিসাবে এজন্মে শূদ্র হয়ে জন্মানো, এই অত্যাচারের মুখোমুখি হওয়া৷ অতএব শূদ্রদের মাথায় ঢোকানো হলো হে শূদ্ররা, তোমরা তোমাদের উপর এই অমানবিক শোষণ অত্যাচারের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করো না৷ কারণ এই শোষন, এই অত্যাচার পূর্বনির্দষ্ট। তোমাদের গতজন্মের কর্মফল। এর প্রতিবাদ করলে তোমাদের ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করা হবে।  ফলত পরের জন্মে আরো অবনতি হবে তোমাদের। কাজেই কোনো প্রতিবাদ না করে মেনে নাও এই অত্যাচার। তাতে পরের জন্মে ঈশ্বরের আশীর্বাদে ব্রাহ্মন বা ক্ষত্রিয়ের ঘরে জন্ম নেবে তুমি। ভোগ করবে অসীম সুখ ও ঐশ্বর্য (শূদ্রদের উপর অমানবিক অত্যাচারের বিভিন্ন শাস্ত্রীয় বিধান নিয়ে পরে একদিন লিখবো নাহয়)।

এভাবেই কর্মান্তরবাদ এদেশে জল ঢেলেছিলো বিদ্রোহের আগুনে। শোষিত শ্রেনীর প্রতিবাদের বর্শার অভিমুখ থেকে নিরাপদ রেখেছিলো শোষক সমাজকে। আর এইকারণেই পৃথিবীর অনান্য দেশে দাসবিদ্রোহ ঘটলেও আধ্যাত্মিকতার পূন্যভুমি এই ভারতে কোনোদিন ঘটে নি কোনো শূদ্র বিদ্রোহ৷ নিশ্চিন্ত নিরাপদে পাঁচ হাজার বছর ধরে অত্যাচার চালিয়ে গেছে উচ্চবর্ণের লোকেরা।

হিন্দুদের উপনিষদ বারোটি। মোটামুটি খ্রীষ্টপূর্ব ৫০০ থেকে ৪০০ অব্দে রচনা হয় এগুলি৷ ভগবদ গীতায় কৃষ্ণ অর্জুনকে যেসমস্ত উপদেশ দিয়েছিলেন তার অনেকগুলিই কঠ উপনিষদ থেকে নেওয়া৷ কারণ গীতা অনেক পরের রচনা৷ কঠ উপনিষদে আছে যম ও নচিকেতার কাহিনী। নচিকেতা যমের কাছে আত্মার বিষয়ে জানতে চাইলে কিছুক্ষন অরাজী থাকার পর যম নচিকেতাকে আত্মার অবিনশ্বরতা বিষয়ে জ্ঞান দেন। রথের উদাহরণ দিয়ে সেখানে আত্মার বিষয়টি বোঝাবার চেষ্টা করা হয়। বলা হয়েছে শরীর রথ, আত্মা রথী, ইন্দ্রিয়গুলি অশ্ব, মন রশি, বুদ্ধি তার সারথি৷ 

বৃহদারণ্য উপনিষদে বলা হয়েছে 'মনো বৈ ব্রহ্মোতি অমনসো হি কি সাৎ?' (৪/১/৬), অর্থাৎ মনই ব্রহ্মা, মন হীনের কি সিদ্ধ হতে পারে? 

মৈত্রী উপনিষদে বলা হয়েছে 'যিনি শুদ্ধ...শান্ত...শাশ্বত, অজাত...তার দ্বারাই এই শরীর চেতন রূপে থাকে। অর্থাৎ আত্মার শুধু শাশ্বতই নয়, আত্মার দ্বারাই চেতনার উৎপত্তি।

ঋগ্বেদের দশম মন্ডলের আটান্ন সুক্তে আছে

যত্তে যমং বৈবস্বতং মনো জগাম দূরকম।

তত্ত আ বর্তয়ামসী হ ক্ষয়ায় জীবসে।।

যত্তে দিবং যৎ পৃথিবীং মনো জগাম দূরকম।

তত্ত্ব আ বর্তমায়সী ক্ষয়ায় জোবসে।।

অর্থাৎ, তোমার যে মন অতিদূরে বিবস্বনের পুত্র যমের নিকট তাকে আমরা ফিরিয়ে আনছি। জীবিত হয়ে ইহলোকে বাস করো।

তোমার যে মন অতিদূরে স্বর্গে অথবা পৃথিবীতে চলে গিয়েছে, তাকে আমরা ফিরিয়ে আনছি। তুমি জীবিত হয়ে ইহলোকে বাস করো।

বলাই বাহুল্য, এখানে মন ও আত্মা সমার্থক। 

সাংখ্যমতে 'আত্মা চৈতন্যস্বরূপ' (সাংখ্যসূত্র ৫/৬৯ ও সাংখ্যপ্রবচনভাষ্য ২/৪২/৪৭)।

আচার্য শংকর তার ব্রহ্মসূত্রভাষ্যে বলেছেন 'মন হলো আত্মার উপাধিস্বরূপ। 

শ্রীভাষ্যকার রামানুজের মতে 'আত্মা চৈতন্যস্বরূপ'।

শাক্ত দর্শনে বলা হয়েছে 'মন অন্য নয়, আত্মাই মন' (ত্রিপুরারহস্যতন্ত্র ১৭/১১৭, ৪৭)

যোগবাশিষ্ঠরামায়নে বলা হয়েছে 'স্বপ্রকাশ চৈতন্যস্বরূপ আত্মাই যখন মননশক্তি ধারণ করে, তখন মন বলে অবহিত হয়', অর্থাৎ চৈতন্য বা মনই আত্মা (যোগবাশিষ্ঠ রায়ন, উৎপত্তিপ্রকরণ, ১০০/১৪)। 

স্বামী বিবেকানন্দের মতে 'চৈতন্য বা চেতনাই আত্মা' (বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র, অখন্ড সং- প্রকাশক নবপত্র, পৃষ্ঠা ১৬২)।

কি মাথা ঘুরছে এতরকম মতবাদ পড়ে? দাঁড়ান বন্ধু। এ তো সবে কলির সন্ধ্যা৷ শুধু তো হিন্দুধর্মে আত্মার বর্ণনা দিতেই কেটে গেলো এতটা সময়৷ এরপর আসবে মুসলিম, খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন ও অনান্য আদিবাসী ধর্মের আত্মার বিভিন্ন বর্ণনা। দেখবেন একের সাথে অন্যের কেমন আকাশ পাতাল পার্থক্য। কারো সাথে কারো বক্তব্য মেলে না। এ যায় ডানদিকে তো ও যায় বামে। অথচ অদ্ভুতভাবে সবাই বিশ্বাস করে তার ধর্মের বক্তব্যই একমাত্র সঠিক, বাকি সব মিথ্যা৷ কেন মিথ্যা, কিভাবে মিথ্যা,  কিভাবে জানা গেলো আপনার ধর্মের আত্মার বর্ণনাটাই ঠিক, অনান্য গুলো মিথ্যা, প্রমান করতে পারবেন অনান্য ধর্মের আত্মার বর্ণনা ভুল, ঠিক শুধু। আপনারটি?  ইত্যাদি প্রশ্ন করবেন না৷ কারণ এর কোনো উত্তর ধর্মবিশ্বাসীদের কাছে নেই। অথচ এতরকম মতবাদ একইসাথে সত্য হতে পারে না। হয় যেকোনো একটি সত্যি, আর নয়তো সবগুলিই মিথ্যা৷ কোনটা সত্যি তা প্রমান করার দায় তো আস্তিক ও ধর্মগুরুদের। আমরা শুধু মজা দেখবো।  যাই হোক, হিন্দুধর্মের আত্মার বিভিন্ন বর্ণনা তো পড়লেন। এবার একটু যাওয়া যাক অন্য দিকে। দেখা যাক বিভিন্ন আদিবাসী সম্প্রদায় ও অনান্য বিভিন্ন ধর্মে আত্মার বিষয়ে কী বলা হয়েছে। প্রথমেই আসি আদিবাসীদের আত্মা সম্পর্কিত বিশ্বাসে। এখানেও বারো গেরস্তর তেরো হাঁড়ি। অর্থাৎ কারো ধারণার সাথে কারো ধারণা মেলে না। অথচ প্রত্যেকেই আবার মনে করে তার ধর্মের বা তার কমিউনিটির বিশ্বাসটাই একমাত্র সত্য, বাকি সব মিথ্যা 

ছোটনাগপুর ও মধ্যপ্রদেশের আদিবাসীদের ধারণা মানুষের ছায়াই হলো তার আত্মা।

কুকি ও মণিপুরের পুরুম সম্প্রদায়ের আদিবাসীদের বিশ্বাস প্রতিটি মানুষের মধ্যে রয়েছে পাঁচটি করে আত্মা।

বীরহোররা মনে করে প্রতিটি মানুষের মধ্যে আছে তিনটি করে আত্মা। তার মিধ্যে একটাকে প্রায়ই দেখা যায়, তা হলো মানুষের ছায়া।

নীলগিরির টোডা সম্প্রদায়ের মানুষের মতে মানুষের আত্মা ঠিক তার মতই দেখতে।

মালয়ের মানুষের বিশ্বাস আত্মার রঙ লাল। আয়তনে তা ভুট্টার দানার মতো।

প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জের অনেক আদিবাসী গোষ্ঠীর ধারণা আত্মা তরল।

অষ্ট্রেলিয়ার আদিবাসীরা বিশ্বাস করে আত্মা থাকে বুকের বামদিকে। আয়তনে খুব ছোট্ট।

প্রাচীন মিশরীয়রা বিশ্বাস করতো প্রতিটি মানুষের মধ্যে হাত পা ও অনান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে একটা ছোট্ট মানুষ বাস করে৷ এটাই হলো তার আত্মা।

জাপানীরা বিশ্বাস করে আত্মার রঙ কালো।

চলুন এবার যাই বিদেশের দিকে বা অনান্য ধর্মগুলির দিকে। ইহুদীরা মনে করে প্রাণই আত্মা, আত্মাই প্রাণ৷ তারা বিশ্বাস করে জিহোবা মানুষের নাকে ফুঁ দিয়ে প্রাণময় আত্মার সঞ্চার করেছিলেন। তাদের বিশ্বাস আত্মা থাকে হৃদপিন্ডে।  সেখান থেকেই শক্তি সঞ্চারিত হয় সারাদেহে৷  হৃদপিন্ডই থেকেই উৎসারিত হয় চিন্তা, চেতনা, প্রেম,  আনন্দ ইত্যাদি (বাস্তবে রক্তসঞ্চালন করা ছাড়া হৃদপিন্ডের কোনো ভূমিকা নেই। চিন্তা চেতনা উৎসারিত হয় মস্তিষ্ক থেকে। এসব গাঁজাখুরি তত্ত্বে বিশ্বাস করবেন না)।

হোমারের সময় ও তার পরবর্তীকালে গ্রীকরা বিশ্বাস করতো শ্বাসই আত্মা। মারা গেলে শ্বাস দেহ থেকে বিচ্যুত হয়৷ তবে মৃতদেহ যতক্ষন রক্ষিত থাকবে ততক্ষন আত্মা থাকবে মৃতদেহেই। মৃতদেহের সৎকার করার পর আত্মা বাতাসের সাথে মিশে যাবে।

ইসলাম ও খ্রীষ্টধর্মে আত্মার বর্ণনা মোটামুটি একই। আত্মা এখানে দেহাতীত একটি স্বত্তা। এবং মৃত্যুর পরে আত্মা বেহেস্তে (স্বর্গ)  বা দোজখে (নরকে) যায় এবং শেষ বিচারের দিন অবধি সেখানে অনন্ত সুখ বা অনন্ত দুঃখ ভোগ করে। হিন্দুধর্মের মতো পুনর্জন্মের তত্ত্বে বিশ্বাসী নয় এই দুই ধর্ম। খ্রীষ্টানরা আবার ভালো আত্মা  ও দুষ্ট আত্মা এই দুইপ্রকার আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে। 

আত্মা নিয়ে বিভিন্ন ধর্ম ও উপজাতির পরস্পরবিরোধী মতামতগুলো দেখলেন। এবার দেখা যাক সত্যিই আত্মার অস্তিত্ব আছে কিনা সেই প্রশ্নে। 

বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে আত্মা বলতে তাকেই বলা হয়েছে, যে শক্তি আমাদের দেহকে পরিচালনা করে, যা মৃতদেহ বা জড়বস্তু থেকে জীবিত প্রানীকে পৃথক করে। ধর্মগ্রন্থের মতে আমাদের চিন্তা চেতনার উৎস হলো আত্মা। আত্মার কারণেই আমরা চিন্তা করতে পারি, কোনো বিষয়ে ভাবতে পারি, শরীরের নানা মুভমেন্ট, চলন, গমন, বাক নির্গমন করতে পারি ইত্যাদি। অর্থাৎ খুব সোজা কথায় বললে, মনই হলো আত্মা। এখন মন কী? মানুষের শরীর কুচিকুচি করে কাটলেও কিন্তু 'মন' বলে কোনো অঙ্গ দেখা যাবে না। তাহলে আমরা চিন্তাভাবনা করছি কী করে?  কী করেই বা বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে নানা নির্দেশ দিচ্ছি? আসলে পুরোটাই পরিচালিত হচ্ছে মস্তিষ্ক থেকে। মস্তিষ্কের অত্যন্ত জটিল বিভিন্ন কার্যপ্রনালী, অসংখ্য স্নায়ুতন্ত্র ও মস্তিষ্ককোষের জটিল সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি সুসংহত সিস্টেম আমাদের সাহায্য করছে কোনো বিষয়ে চিন্তাভাবনা করতে বা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে নানা নির্দেশ দিতে৷ কিন্তু প্রাচীন মানুষের কাছে আজকের বিজ্ঞানের এই গবেষনালব্ধ জ্ঞানগুলি ছিলো অজানা। মানবশরীরের বিভিন্ন রহস্যও তাদের জানা ছিলো না৷ জানা ছিলো না স্নায়ুতন্ত্র বা মস্তিষ্ক কোষের অস্তিত্বের কথা, যার সাহায্যে আমরা চিন্তাভাবনা করতে পারি। প্রান ছিলো তাই তাদের কাছে রহস্যময় একটি বিষয়। ফলে তারা মনে করতো আমাদের শরীরে নিশ্চয়ই এমন কোনো অতিপ্রাকৃত সত্তা আছে যার ফলে  আমরা চিন্তাভাবনা করতে পারি, নানারকম অঙ্গসঞ্চালন করতে পারি। কিন্তু আজ আমরা জানি এরকম কোনো সত্ত্বার অস্তিত্ব নয়, মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের নানা জটিল ক্রিয়াকলাপই আমাদের চিন্তা চেতনা ও অনান্য ক্রিয়াকলাপের জন্য দায়ী। জড়বস্তুর মধ্যে এই মস্তিষ্ক বলে বিষয়টি নেই, নেই অনান্য ক্রিয়াকর্মের উপযোগী অঙ্গপ্রত্যঙ্গও৷  তাই জড়বস্তুর মধ্যে প্রাণের লক্ষনও দেখা যায় না। এটাই মূল ব্যাপার। কোনো অতিপ্রাকৃত স্বত্তাকে এর মধ্যে টেনে আনার দরকার নেই। আবার প্রানীদেহের মৃত্যুর সাথে সাথে তার মধ্যে প্রানের বৈশিষ্ট্যের জন্য দায়ী মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষেরও মৃত্যু ঘটে৷ তারপর তা পোড়ানো হয় আগুনে বা কবর দেওয়া হয় মাটিতে। অর্থাৎ তথাকথিত 'মন'কে হয় আগুনে পোড়ানো হয়, নয় মাটির সাথে মেশানো হয়। এরপর মনের আর কোনো অস্তিত্ব থাকা সম্ভব নয়। মনের অস্তিত্ব থাকা সম্ভব নয় মানে সম্ভব নয় আত্মার অস্তিত্ব থাকাও।

প্রশ্ন উঠবে তাহলে মৃত মানুষের মধ্যে প্রাণের লক্ষন দেখা যায় না কেন৷ তারও তো সমস্ত স্নায়ুকোষ, সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ আছে। সোজা উত্তর, শুধু বিভিন্ন অর্গানগুলি থাকলেই হবে না, সেগুলিকে সচল রাখার শক্তি থাকতে হবে৷ নয়তো প্রাণের লক্ষণ তার মধ্যে থাকবে না৷  ঠিক যেমন একটা ফ্যানের সমস্ত পার্টস ঠিকঠাক থাকলেও ইলেকট্রিসিটি না থাকলে ফ্যান চলবে না ঠিক তেমনই।

প্রশ্ন উঠবে ফ্যানের ঘুর্ননের জন্য যে শক্তি দরকার তা আসে ইলেকট্রিসিটি থেকে৷ কিন্তু মানুষের মধ্যে প্রানের এই শক্তি আসে কোথা থেকে? মৃত্যুর পরেই বা সেই শক্তি কোথায় যায়? উত্তর কোথাও থেকে আসে না। আবার মৃত্যুর পরেও কোথাও যায় না। এটা প্রানেরই নিজস্ব ধর্ম। আগুনের ধর্ম যেমন সমস্ত কিছুকে পোড়ানো, অ্যাসিডের ধর্ম যেমন ধাতুকে গলানো, তেমনই। অ্যাসিডের এই যে ধাতুকে গলানোর ক্ষমতা, এই ক্ষমতা কোথা থেকে আসে?  উত্তর এটা কোথাও থেকে আসার বা কোথাও যাওয়ার কোনো ব্যাপার নেই এর মধ্যে। এটা অ্যাসিডেরই নিজস্ব ধর্ম। আগুনের এই যে সমস্ত কিছুকে পোড়ানোর যে শক্তি, সেই শক্তি কোথা থেকে আসে? আবার আগুন নিভিয়ে দিলেই বা সেই শক্তি যায় কোথায়? উত্তর কোথা থেকে আসেও না, কোথাও যায়ও না৷ পোড়ানোটাই আগুনের সহজাত ধর্ম৷ ঠিক তেমনি প্রাণেরও সহজাত ধর্মই হলো প্রাণের বিভিন্ন লক্ষন যথা চিন্তাভাবনা করা বা বিভিন্ন শারীরবৃত্তিয় কাজ পরিচালনা করা ইত্যাদি। প্রশ্ন উঠতে পারে সম্পুর্ন জড় উপাদান দিয়ে তৈরী প্রানীদেহে জড়বস্তুর বৈশিষ্ট্য বহির্ভূত প্রানের লক্ষন আসে কোথা থেকে?  উত্তর, হাইড্রোজেন ও অক্সিজেন কোনোটার মধ্যেই যেমন জলের কোনো বৈশিষ্ট্য নেই, কিন্তু বিশেষ প্রক্রিয়ায় বিশেষ অনুপাতে দুটিকে মেশালে তা থেকে জল তৈরী হয়, যার বৈশিষ্ট্য হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের বৈশিষ্ট্য থেকে সম্পূর্ন পৃথক, ঠিক তেমনি জড় উপাদান দিয়ে প্রাণ তৈরী হলেও তার বৈশিষ্ট্য জড় উপাদান থেকে পৃথক।

বৌদ্ধগ্রন্থ মিলিন্দ পঞহোতে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী নাগসেনের সাথে রাজা মিলিন্দের কথোপকথনের একটি বর্ণনা আছে, যাতে সুন্দর ভাবে তুলে ধরা হয়েছে আত্মার অবিনশ্বর তত্ত্বের অসাড়তাকে।

মিলিন্দ- মৃত্যুর পরে আত্মা কোথায় যায়? 

নাগসেন- কোথাও যায় না রাজন। দেহের সাথে সাথে তারও মৃত্যু ঘটে৷

রাজা মিলিন্দ সন্ধিগ্ন। সন্তুষ্ট নন এই উত্তরে।

নাগসেন বুঝতে পারেন রাজার মনোভাব। বিনয়ের সাথে প্রশ্ন করেন- মহারাজ, বলতে পারেন, প্রদীপ নেভানোর পর আগুনের শিখা কোথায় যায়?

এবার রাজা মিলিন্দের ভুল ভাঙে। বুঝতে পারেন নাগসেনের তত্ত্বের যথার্থতা। 


এরপরেও যারা গাঁইগুঁই করবেন আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে, তাদের জন্য রইলো সরাসরি কিছু প্রশ্ন-

১) বিভিন্ন ধর্মে আত্মার বিভিন্ন বর্ণনা দেওয়া হয়েছে৷ এতটাই পরষ্পরবিরোধী সেগুলি যে তার একটাকে মানতে গেলে বাতিল করতে হয় অন্যগুলো। এখন পৃথিবীর ৪২০০টা ধর্মের ৪২০০ রকম পৃথক পৃথক আত্মার বর্ণনার মধ্যে আপনি ঠিক কোনটিকে মানবেন ও কেন মানবেন? কিসের ভিত্তিতে মানবেন যে আপনার পছন্দের ওই ধর্মের বর্ণনাটাই ঠিক, বাকি সব ভুয়ো? কিভাবে প্রমান করবেন একমাত্র আপনার পছন্দের ধর্মের আত্মার বর্ণনাটাই ঠিক, বাকি সব ভুল? 'অন্ধবিশ্বাস' ছাড়া আর কোনো পথ আছে কি আপনার কাছে? না নেই। এবং মনে রাখবেন, বিজ্ঞানের কাছে কিন্তু কোনো বিশ্বাস বা কোনো তত্ত্বের বিন্দুমাত্র দাম নেই, যতক্ষন না সেই বিশ্বাসটি বা সেই তত্ত্বটির যথার্থতা 'প্রমানিত' হচ্ছে। 'প্রমান' বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানের কাছে। বিজ্ঞান বিশ্বাস করে যুক্তি ও প্রমানে। যুক্তি ও প্রমান ছাড়া বিজ্ঞানের দরবারে কোনো তত্ত্ব গ্রহনযোগ্য নয়, তার পিছনে যতবেশী মানুষেরই সমর্থন থাকুক না কেন বা যত বেশীদিন ধরেই সেই বিশ্বাসটি জনমানসে চলে আসুক না কেন।


২) যখন পৃথিবী তথা সৌরমন্ডলের জন্ম হয় নি, তখন আত্মাগুলি কী করছিলো?  কোথায় ছিলো? যখন ব্রহ্মান্ডেরই জন্ম হয় নি, বিগ ব্যাং যখন সংগঠিত হয় নি, তখন কোথায় থাকতো আত্মারা? কী করতো তারা তখন? 


৩) সৃষ্টির প্রথমে ছিলো মাত্র একটি প্রাণ৷ অর্থাৎ তার মধ্যে ছিলো মাত্র একটি আত্মা। অথচ আজ পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যাই সাতশো কোটি৷ অনান্য প্রানী ও উদ্ভিদের কথা তো বাদই দিলাম। তাহলে এত প্রানীর মধ্যে এত আত্মা আসলো কোথা থেকে? ওই একটি আত্মা কী ভাগ হয়ে এতগুলো আত্মা হলো? কিন্তু ধর্মগ্রন্থ তো বলছে আত্মাকে কাটা যায় না। আবার আত্মা নাকি নতুন করে জন্মায়ও না বা তার মৃত্যুও হয় না৷ তাহলে এত জনসংখ্যা ও অনান্য প্রানীসংখ্যা বৃদ্ধির ব্যাখ্যা কী?  


৪) হিন্দুধর্ম অনুযায়ী প্রতিটি প্রাণী নাকি তার পূর্বজন্মের কর্মফলে এ জন্মে পৃথিবীতে জন্মায়। অর্থাৎ পূর্বজন্মে ভালো কাজ করলে এ জন্মে ব্রাহ্মন বা পূর্বজন্মে খারাপ কাজ করলে এ জন্মে শূদ্র বা পোকামাকড় হয়ে জন্মায় ইত্যাদি। তা পুর্বজন্ম পূর্বজন্ম করে পিছাতে পিছাতে পৃথিবীতে প্রথম যে প্রাণ সৃষ্টি হয়েছিলো সেটি তার কোন পূর্বজন্মের কর্মফলে পৃথিবীতে এসেছিলো? 


৫) পৃথিবীতে যখন প্রাণের উদ্ভব হয় নি, তখন আত্মাগুলো কোথায় স্তূপাকারে রাখা ছিলো? এই সৌরমন্ডলের মধ্যেই, না বাইরে কোথাও? সৌরমন্ডলের মধ্যে রাখা থাকলে ঠিক কোন জায়গায় রাখা ছিলো? বৃহস্পতি আর শনির মাঝে, নাকি মঙ্গল  আর শুক্রের মাঝে? নাকি গ্রহানুপুঞ্জের মধ্যে? নাকি অন্য কোথাও? কিভাবে জানলেন ঠিক সেখানেই রাখা ছিলো? 

৬) স্বর্গ ও নরক জায়গাগুলি ঠিক কোথায়? সেটি কি সৌরমন্ডলের মধ্যেই, নাকি বাইরে কোথাও? সৌরমন্ডলের মধ্যে হলে ঠিক কোন জায়গায়? বুধ আর মঙ্গলের মাঝখানে, নাকি ইউরেনাস আর নেপচুনের মাঝখানে? নাকি অন্য কোথাও?  কারণ বিজ্ঞানীরা সৌরমন্ডলের মধ্যে এরকম কোনো জায়গার খোঁজ পান নি। সৌরমন্ডলের বাইরে হলেই বা ঠিক কোন জায়গায়? কিভাবে জানলেন ঠিক সেই জায়গাতেই স্বর্গ বা নরক আছে? গিয়ে দেখেছেন? শক্তিশালী দূরবীনের সাহায্যে আমরা এখন সৌরমন্ডলের বাইরেও কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরের জিনিস দেখতে পাই। কিন্তু এখনও অবধি বিজ্ঞানীরা এরকম কোনো জায়গার খোঁজ পান নি যেটা ধর্মগ্রন্থ বর্ণিত স্বর্গ বা নরক হতে পারে, যেখানে আত্মারা সব কিলবিল করছে। তাহলে স্বর্গ নরক জায়গাগুলি ঠিক কোথায়? 

 

৭) হিন্দুধর্মে বলা হয়েছে আত্মাকে আগুনে পোড়ানো যায় না, অস্ত্রে বিদ্ধ করা যায় না, জলে ভেজানো যায় না, আবার এদিকে অনান্য ধর্মের মতো হিন্দুধর্মেও নরকে আত্মার শাস্তির বিভিন্ন উদাহরণ দেওয়া হয়েছে। একটু ভেবে দেখুন তো, যাকে আগুনে পোড়ানো যায় না, অস্ত্রে বিদ্ধ করা যায় না, তাকে আদৌ কোনো শাস্তি দেওয়া সম্ভব কিনা? এগুলো তো সম্পুর্ন স্ববিরোধী কথাবার্তা। কাজেই যদি আপনি গীতায় বর্ণিত আত্মাকে আগুনে না পোড়াতে পারার, অস্ত্রে বিদ্ধ না করতে পারার তত্ত্বে বিশ্বাস করেন, তাহলে আপনাকে নরকে আত্মাকে শাস্তি দেবার তত্ত্বে অবিশ্বাস করতে হবে, আবার নরকে আত্মার শাস্তির তত্ত্বে বিশ্বাস করলে গীতায় দেওয়া আত্মার তত্ত্বে অবিশ্বাস করতে হবে। দুটো একসাথে বিশ্বাস করা সম্ভব নয়৷ অথচ মুশকিল হলো হিন্দুধর্মে এই দুই পরস্পরবিরোধী কথা একইসাথে বলা হয়েছে।


কাজেই, এই দীর্ঘ আলোচনার শেষে আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি আত্মা শুধুমাত্র একটি কুসংস্কার বিশেষ৷ দেহাতীত আত্মার কোনো অস্তিত্ব নেই৷ আর আত্মার অস্তিত্ব নেই মানেই অস্তিত্ব নেই ভূতেরও।

বুদ্ধ কোনো ভগবান ছিলেন না -
চিত্রদীপ সোম
Nov. 16, 2024 | বৌদ্ধধর্ম | views:818 | likes:2 | share: 2 | comments:0

বুদ্ধ কোনো ভগবান ছিলেন না। ছিলেন একান্তভাবেই দোষ গুন মিশিয়ে একজন মানুষ। বরঙ ছিলেন সেই ব্যতিক্রমী ধর্মপ্রচারকদের অন্যতম যিনি কোনো কাল্পনিক ঈশ্বরের মহিমা প্রচার করেন নি মানুষের মধ্যে। মানুষ ও তার ইহজীবনই ছিলো তাঁর মতবাদের বিষয়বস্তু। এখানেই তিনি খ্রীষ্ট মহম্মদ বা শংকরাচার্য সহ অনান্য সমস্ত ধর্মপ্রচারক থেকে আলাদা৷ অথচ সেই বুদ্ধকেই আজ ভগবান হিসাবে পুজো করা হয়, নবম অবতার মনে করা হয়, এর চেয়ে হাস্যকর ও আপত্তিকর কিছুই হতে পারে না।


প্রসঙ্গতঃ বুদ্ধের যে ছবি বা মূর্তিগুলি দেখি আমরা তার কোনোটাই তাঁর আসল রূপকে তুলে ধরে না। বুদ্ধের আসল চেহারা আমাদের অজানা। কারণ বুদ্ধের জীবিতকালে তাঁর কোনো মূর্তি বা ছবি বানানো হয় নি। বুদ্ধের প্রথম মূর্তি বানানো বা ছবি আঁকা হয় তাঁর মৃত্যুর প্রায় পাঁচশো বছর পর। বলাবাহুল্য সেই শিল্পীরা কেউই চোখে দেখেন নি বুদ্ধকে। তাই কল্পনাই ছিলো তাদের একমাত্র ভরসা। গান্ধার শিল্পরীতিতে প্রস্তুত এইসব ছবি বা মূর্তিগুলি তাই বুদ্ধকে সঠিকভাবে তুলে ধরে না। বরঙ এই মূর্তি বা ছবিগুলোর সাথে অনেক বেশী মিল পাওয়া যায় গ্রীক দেবতাদের।


যে সময় আসমুদ্র হিমাচল ছিলো গোঁড়ামি, জাতপাত, আর কুসংস্কারে নিমজ্জিত, সেই সময় দাঁড়িয়ে তিনি বেদ ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ধ্বজা তুলে ধরলেন। দৃঢ়তার সাথে বেদের অপৌরুষেয়তাকে অস্বীকার করলেন৷ অস্বীকার করলেন স্বর্গ নরকের ছেলেভোলানো গালগল্পকে। অস্পৃশ্যতাকে ছুড়ে ফেলে দিতে চাইলেন সমাজ জীবন থেকে৷ আজ এই একবিংশ শতাব্দীতে এসেও যখন দেখি কোনো বিজ্ঞানের অধ্যাপকের হাতে গ্রহরত্নের আংটি, ডাক্তারকে দেখি অপারেশনের আগে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করতে, তখন বুঝতে অসুবিধা হয় না কী সাংঘাতিকভাবে সময়ের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন এই মানুষটি। বুঝতে অসুবিধা হয় না আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগের তমসাঘন অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ে দাঁড়িয়ে দেবদ্বিজকে অস্বীকার করতে হলে কতটা কলজের জোর দরকার হয়েছিলো তাঁর।


বুদ্ধ সাধারণ মানুষ ছিলেন না। ছিলেন রাজ পরিবারের সন্তান। মানুষ হয়েছেন রাজ বৈভবের মধ্যে। পরবর্তীকালেও পেয়েছেন রাজঅনুগ্রহ৷ তাই মানুষের দুঃখকষ্টের বস্তুবাদী কারণ অনুসন্ধান তাঁর পক্ষে সম্ভব হয় নি। মানুষের দুঃখকষ্টের পিছনে যে সম্পদের অসম বন্টন লুকিয়ে আছে তা তাঁর দৃষ্টিগোচর হয় নি। ইহজীবনের দুঃখের জন্য তিনি ভুলভাবে দায়ী করে গেছেন কামনা ও বাসনাকে। মনে করেছেন কামনা বাসনার অবসান হলেই দুঃখের নিবৃত্তি সম্ভব। এটা বুদ্ধের সীমাবদ্ধতা। বুদ্ধের সময়ের সীমাবদ্ধতা। বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদ বিকাশের সময় সেটা ছিলো না৷ ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক রূপ তাই বুদ্ধের চোখে ধরা পড়ে নি। কিন্তু এই সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যেটুকু ইতিবাচক দর্শনের সূচনা তিনি করেছেন তাতে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হতেই হয়।


অহিংসা ছিলো তাঁর ধর্মের মূল কথা। কিন্তু এখানেও তিনি ছিলেন বাস্তববাদী। জৈন ধর্মের মতো ইঁটকাঠ পাথরেও তিনি প্রানের অস্তিত্ব খুঁজে বেড়ান নি। উপরন্তু অসুখ হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী মাংস খাওয়ারও বিধান দিয়েছেন৷ এ থেকে বোঝা যায় বাস্তবতাবর্জিত আদর্শবাদী তিনি ছিলেন না। বরঙ বাস্তবতাবোধ নিয়ন্ত্রণ করেছে তাঁর নীতিবোধকে। ঘন ঘন যুদ্ধের রাজতন্ত্রের যুগে দাঁড়িয়ে তিনি গেয়ে গেছেন অহিংসার জয়গান, জীবনের জয়গান। যুদ্ধবন্দীদের দাস বানানো, যুদ্ধবন্দীনিদের যৌনদাসী বানানো, বিধর্মীদের উদ্দেশ্যে রক্তাক্ত যুদ্ধে মদত দেওয়া, পরকালে সুন্দরী মহিলার লোভ দেখানো, ইত্যাদি তাঁর চরিত্রে ছিলো না। ছিলেন একান্তভাবেই সত্য ও সুন্দরের উপাসক। আজ যখন যুদ্ধে দীর্ণ, ভাতৃঘাতী হানায় দীর্ন পৃথিবীকে দেখি, তখন অনুভব করি বুদ্ধের উপদেশ আজও কী পরম প্রাসঙ্গিক।


রোমিলা থাপার বলেছিলেন বিশ্বকে দেওয়া ভারতের শ্রেষ্ঠ উপহার গৌতম বুদ্ধ৷ আমার মতও তাই। শুধু ভারত নয়, এই পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান তিনি। এই হিংসা, হানাহানিতে ভরা পৃথিবীর বুকে তাই জেগে থাকুন বুদ্ধ, জেগে থাকুক তাঁর বরাভয়ের মুদ্রা। প্রতি বুদ্ধ পূর্ণিমা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিক রাজকীয় বিলাসিতাকে হেলায় পরিত্যাগ করা এই ক্ষত্রিয় সন্ন্যাসীকে।


ওঁং বুদ্ধং শরণম গচ্ছামি।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929